ই-পেপার

ফেসবুকে চুরির অপবাদ দিয়ে ভিডিও প্রকাশ, স্কুলছাত্রীকে টিসি

নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট: August 23, 2022

স্কুলছাত্রীর হাত ধরে টানা হেচড়া এবং যৌন হয়রানির পর চুরির অপবাদ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার পরে দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে স্কুল থেকে টিসি দেওয়ায় অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি ঘটেছে বরিশাল সরকারি শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।

এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া প্রসাধনী দোকানের দুই কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশ। এরা হলেন নগরীর ভাটিখানা এলাকার আউয়াল (৩৭) এবং বাপ্পা (২৫)। এদের মধ্যে বাপ্পা দোকানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। বাপ্পা ভাটিখানা এলাকার শেখ কবিরের ছেলে।

এছাড়া ওই স্কুলছাত্রী বরিশাল নগরীর সাগরদী ধানগবেষনা এলাকার বাসিন্দা এবং রূপাতলী শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। তার বাবা একজন ব্যবসায়ী এবং মা বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স।

অভিযোগ উঠেছে, রহস্যজনক কারণে সোমবার রাতেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বরং থানায় বসে সালিশ মিমাংসা করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে অভিযুক্ত দুই দোকান কর্মচারীকে। যদিও কোতয়ালী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ আজিমুল করিম জানিয়েছেন, ছাত্রীর পরিবার দুই যুবককে ক্ষমা করে দেয়ায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ‘গত ৫ আগস্ট স্কুলছাত্রী নগরীর গির্জা মহল্লা উলফৎ প্লাজায় ‘প্রিয়াঙ্কা কসমেটিক্স’ নামক একটি দোকানে কেনাকাটা করতে যায়। এসময় ওই ছাত্রী দোকান থেকে মালামাল নিয়ে ভুলবসত টাকা না দিয়ে চলে আসার চেষ্টা করে। তখন দোকানের কর্মচারীসহ অন্যরা মিলে তাকে আটকে চোর আখ্যা দিয়ে ভিডিও ধরণ করে। পরে মেয়েটিকে হাতধরে টানা হেচড়া করে দোকানের পাশে নিয়ে আটকে রাখে। এরপর স্কুলছাত্রীকে চোর আখ্যা দিয়ে ভিডিও ফুটেজ ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয় দোকানি।

শিক্ষার্থীর পরিবারের অভিযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া ভিডিও ছাত্রীর স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকরা দেখতে পান। এজন্য ২২ আগস্ট সোমবার দুপুরে ছাত্রীর মাকে স্কুলে ডেকে নিয়ে প্রধান শিক্ষক টিসি ধরিয়ে দেন।

এদিকে, ‘স্কুল থেকে টিসি দেওয়ায় লজ্জা এবং ঘৃণায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ওই শিক্ষার্থী। বিষয়টি বুঝতে পেরে পরিবারের সদস্যরা সোমবার রাতে থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ গির্জা মহল্লার প্রিয়াঙ্কা কসমেটিক্স দোকানের কর্মচারী আউয়াল ও বাপ্পাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে।

অপরদিকে, টিসি দেয়ার বিষয়ে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পাপিয়া জেসমিন বলেন, ‘ওই ছাত্রীকে স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে টিসি দেয়নি। শিক্ষার্থীর মায়ের লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে টিসি দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ওই ছাত্রীকে নিয়ে যে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেটা আমিও দেখেছি। তবে এটা অনেক আগের ঘটনা। আর টিসি দেয়া হয়েছে ২২ আগস্ট। তাছাড়া আমি যে ভিডিও দেখেছি সেটা ওই ছাত্রী বা তার পরিবারকে কখনো বুঝতেও দেইনি।

প্রধান শিক্ষক দাবি করেন, ‘ওই ছাত্রী ক্লাসে অনিয়মিত। সে নিয়মিত স্কুলে আসে না। আবার আসলেও দেরি করে আসে। গত দুদিন পূর্বে স্কুলে অনুপস্থিত দেখে তার মাকে বিষয়টি জানানো হয়। তার মা জানায় মেয়ে স্কুলে গেছে। আবার রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্কুল ড্রেস এবং বই-খাতা ছাড়া স্কুলে আসে। পুনরায় তার গার্ডিয়ানকে ফোন করে জানালে তারা বলে মেয়ে স্কুলে যায়নি। অথচ সে ওইদিন দেরী করে স্কুলে আসে।

তিনি বলেন, ওই ছাত্রীর নামে আগে থেকেই টুকিটাকি অভিযোগ এবং দোষ আছে। কিন্তু আমরা সেগুলো ক্ষমার দৃষ্টি দেখে ওকে শোধরাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শোধরায়নি। এরপর সোমবার ওই ছাত্রী স্কুলে না আসায় তার মাকে স্কুলে ডেকে এনে মেয়ের সকল ভুল-ত্রুটি এবং অনিয়মের বিষয়ে জানাই। তখন মেয়ের মায়ই আমাদের বলে তার মেয়ে এই স্কুলে পড়তে পারবে না। তাই ওকে টিসি দিতে বলে।

পরে সে পারিবারিক সমস্যার কথা উল্লেখ করে টিসি পেতে একটি লিখিত আবেদন করে। স্কুলছাত্রীর কাছে পাওনা দুই মাসের বেতন রেখে তাকে আমরা টিসি দিয়েছি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও বা ছবি প্রকাশের কারণে তাকে টিসি দেয়া হয়নি। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করেই টিসি দেয়া হয়েছে।

প্রধান শিক্ষক দাবি করে বলেন, ‘বাবা-মায়ের সঠিক তদারকির কারণেই মেয়েটি লেখাপড়ায় অমনযোগী হয়ে পড়েছে। সে স্কুলে আসতেই চাচ্ছিল না। আমি তার মাকে বলেছিলাম আপনার মেয়েকে একটু ডাক্তার দেখান। হতে পারে ওর কোন সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু তারা সেটা করেনি।

এ প্রসঙ্গে কোতয়ালী মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) লোকমান হোসেন বলেন, ‘মেয়েটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় অভিযোগ পেয়ে রাতেই দোকানের কর্মচারী আউয়াল এবং বাপ্পাকে থানায় ডেকে আনা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষের হুট করে টিসি দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি। তাদের বিষয়টি ভালোভাবে যাচাই বাছাই করে দেখা উচিত ছিল।

কোতয়ালী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আজিমুল করিম বলেন, ‘রাতে উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে কথা হয়েছে। দোকানী যুবকদ্বয় নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে। সে ফেসবুকে দেয়া ভিডিওটি রাতেই ডিলেট করে ফেলেছে। এজন্য মেয়ের পরিবারও তাকে ক্ষমতা করে দিয়েছে। তাই তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে টিসি’র বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।

ওসি বলেন, ‘আমি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলেছি। তিনি দাবি করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া ভিডিও বা ছবির জন্য মেয়েটিকে টিসি দেয়া হয়নি। স্কুলে তার সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে টিসি দেয়া হয়েছে। তাছাড়া মেয়ের মা নাকি টিসি চেয়ে আবেদন করেছি। তার পরেও টিসি প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনার জন্য বলেছি।

প্রধান শিক্ষক বলেছেন, মিটিং করে তাকে টিসি দেয়া হয়েছে। এখন সেটা ফিরিয়ে নিতে হলে পুনরায় মিটিংয়ে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পরবর্তী মিটিংয়ে মেয়েটির বিষয়ে পুনরায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে প্রধান শিক্ষক আশ্বস্থ করেছেন।

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন