ই-পেপার

ভাণ্ডারিয়ায় প্রাচীণ ইসলামীক নিদর্শণ পুরাকীর্তি মসজিদ

ভাণ্ডারিয়া (পিরোজপুর) প্রতিবেদক | আপডেট: January 6, 2022

পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় পৌর শহরের মিয়াবাড়িতে খলিফাবাদ আমলে স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন বয়ে বেড়াচ্ছে একটি প্রাচীন পুরাকীর্তি মসজিদ। চমৎকার নির্মাণ শৈলীর এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি খলিফাবাদ আমলের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। যদিও কেউ কেউ বলছেন এটি মুঘল আমলের।

তবে সম্প্রতি উপজেলার ভাণ্ডারিয়া-বরিশাল আঞ্চলিক মহা সড়ক লাগোয়া পৌর শহরের ২নম্বর ওয়ার্ডের মিয়া বাড়ির সামনের একটি মসজিদটি সংস্কার করায় মানুষ এই মসজিদ এক নজর দেখার জন্য এখানে ছুটে আসেন।

এই মসজিদের চার পাশ ঘিরে রয়েছে ফুল বাগান ও তার সামনে রয়েছে একটি পুকুর। পুকুরটিও সংস্কার করা হয়েছে। পুকুরটির ঘাটলা বাধিঁয়ে এবং চার দিকে ওয়াকওয়ে করা হয়। যার শোভা বর্ধণে লাইটিং দিয়ে দৃষ্টনন্দন করা হয়েছে।

জানা যায়, প্রায় সাড়ে ৪‘শ বছর পূর্বে অর্থাৎ খলিফাবাদ আমলে হযরত খানজানআলী (রা.) তালা প্রাচীন চন্দ্রদীপ খ্যাত বরিশাল অঞ্চলে ঘুরতে এসে এ অঞ্চলে কিছু শাহাবা তৈরী করার সময় এখানে ৮টি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করে।

ওই ৭টি মসজিদের মধ্যে বর্তমানে পৌর শহরের ৫নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব-ভাণ্ডারিয়া মিয়া বাড়ি (তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বাড়ি) ২টি, ভাণ্ডারিয়া-বরিশাল আঞ্চলিক মহা সড়ক লাগোয়া পৌর শহরের ২নম্বর ওয়ার্ডের মিয়া বাড়ি (মরহুম আজাহার উদ্দিন মিয়ার বাড়ি) ১টি, সংলগ্ন কাজী বাড়ি ১টি (উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আসমা আখতারের), পুরাতন জেল খানার পিছনে ১টি, ভাণ্ডারিয়া থানার পিছনে ১টি এবং টগরা ফেরিঘাট (১৮৯৭-৯৮-সালের টগরা থানা) ও উপজেলার ১নম্বর ভিটাবাড়িয়া ইউনিয়নের চিংগুরিয়া ভিটাবাড়িয়া সংলগ্ন জোলাগাতি নামক স্থানে ১টি একই সাদৃশ্য মসজিদ ছিল।

যার মধ্যে টগরা ফেরিঘাট (১৮৯৭-’৯৮-সালের টগরা থানা) ও উপজেলার ১নম্বর ভিটাবাড়িয়া ইউনিয়নের চিংগুরিয়া ভিটাবাড়িয়া সংলগ্ন জোলাগাতি নামক স্থানের দুটি ইতো মধ্যে ভাঙনের ফলে কচাঁ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বাকি ৬টি যা দীর্ঘ কাল ধরে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

এর মধ্যে ২নম্বর ওয়ার্ডের মিয়া বাড়ি (মরহুম আজাহার উদ্দিন মিয়ার বাড়ি) গেল বছরে  প্রত্নতত্ত অধিদপ্তর কর্তৃক ২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই প্রাচীন পুরাকীর্তি মসজিদটি সংস্কার করা হয়। যা সংস্কার শেষে সম্প্রতি মরহুম আজাহার উদ্দিন মিয়ার ছেলে বর্তমান প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন (রিপন) মিয়া ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সংরক্ষিত প্রাচীন এ পুরাকীর্তি মিয়াবাড়ি মসজি উদ্বোধন করেণ।

৩০ ফুট লম্বা এবং ১৭ ফুট চরড়া। স্থাণীয়দের ধারণা মতে ১৩শ থেকে ১৬শ খৃষ্টাব্দের মধ্যে এই মসজিদ গুলো নির্মাণ করা হয়। এবং এগুলো যে খলিফাবাদ আমলে স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন তা এই অর্থে বোঝানো হয় কারণ বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী ষাটগম্বুজ মসজিদের নির্মাণ শৈলীর সাথে এর মিল রয়েছে। তবে কেউ কেউ এই মসজিদ গুলো ১৬শ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে নির্মাণ করা হয়েছে বলেও ধারণা করছেন।

ভাণ্ডারিয়া উপজেলার প্রাচীন পুরাকীর্তির এই মসজিদ গুলোর সংস্কারের জন্য প্রাথমিক একটি তথ্য ২০১৯ সালের শুরুর দিতে ঐ সময়ের এ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাজমুল আলম প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরে প্রেরণ করেন। যার পরে বিশেষ ব্যাবস্থায় ১টি সংস্কার হয়। বাকি ৫টি সংস্কার না হওয়ায় তা সংস্কারের দাবি স্ব স্ব স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসুল্লীদের।

সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদ গুলোর দেয়ালে লাল ইট আর চুনা পাথরের মিশ্রণের কাজে দিল্লির লাল ইটের স্থাপত্যরীতির প্রভাব রয়েছে। এর দেয়ালগুলোতে রয়েছে ইটের বিন্যাস, পোড়ামাটির ফলকের কাজ। ছাদের গম্বুজ ও খিলানে এক সময় ছিল সোনালি প্রলেপের কাজ। তবে বর্তমানে তা আর চোখে পড়ে না। রেলিং প্রাচীরে ঘেরা ছোট্ট সুন্দর এই মসজিদগুলোতে মিহরাব এবং এক গম্বুজের ভেতরের অংশ পাথরের ফুল, চমৎকার লতাপাতা ও আরব্য নকশায় খোদাইকৃত।

মসজিদের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে পোড়ামাটির নকশার কাজ, যা মোগল ও স্থানীয় শিল্পরীতির নিপুণ সমন্বয়। ভেতরের চমৎকার ফুলেল নকশায় নির্মিত ‘মসজিদটি নামাজের কাজ ছাড়াও বিচারকার্য এবং সভা পরিচালনার কাজেও ব্যবহৃত হতো’ এমন জনশ্রুতি রয়েছে বলেও জানান স্থানীয় বাসিন্দা তমিজ উদ্দিন কাজল।

আলাপকালে উপজেলার প্রবীণ বাসিন্দা এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মনিরুল হক মনি জোমাদ্দার জানান, পূর্ব ভাণ্ডারিয়া তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বাড়ি একটি প্রাচীন দিঘি রয়েছে। যা ভেলাই চোকদার নামক একজন ধনাট্য জমিদার আনুমানিক পাঁচ একর জমির উপর মুঘল আমলে এ দিঘিটি খনন করেন। পরে ভাণ্ডারিয়া কৃতি সন্তান তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ছোট ছেলে সাবেক মন্ত্রী, জাতীয় পার্টি-জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পারিবারিক উদ্যোগে এ দিঘিটি সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী করেন।

ঘুরে দেখা যায় এ দিঘির পাড়ে একটি মসজিদসহ দু’টি দালান প্রাচীন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও এই মসজিদগুলোর নির্মানকাল বা নির্মাতার নিশ্চিত পরিচয় জানা যায়নি, তারপরেও স্থাপনারীতি এবং এই সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণে ধারনা করা হয় খলিফাবাদ আমলের শেষ দিকে বা মোগল আমলের শুরুর দিকে সম্ভবত এই স্থাপনাগুলি নির্মিত হয়ে ছিলো।

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন