ই-পেপার

অভিযান-১০ লঞ্চে এখনো ছড়িয়ে আছে মানুষের হাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট: January 16, 2022

আজও সুগন্ধার পানিতে কঙ্কালের মতো ভেসে আছে ২৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে মাঝ নদীতে পুড়ে যাওয়া এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি। এখান থেকে এখনও পোড়া মানুষের গন্ধ ছড়াচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের পর কয়েকদিন ঝালকাঠি লঞ্চ টার্মিনালে থাকলেও সেখান থেকে লঞ্চটি ঝালকাঠির ডিসি পার্ক সংলগ্ন সুগন্ধা নদীতে এনে রাখা হয়। ঝালকাঠির ডিসি পার্কের পাশে নোঙর করে রাখা আছে।

সরেজমিনে লঞ্চটি দেখলে হৃদয় কেঁপে ওঠে যে কারোরই। লঞ্চটি তিন তলা, প্রতিটি তলাতেই আগুনে পোড়ার চিহ্ন, সবকিছু পুড়ে কোথাও কালো ছাই, কোথাও কালো কয়লা। যাত্রীদের সঙ্গে থাকা পোড়া জিনিসপত্র বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে আজও। লঞ্চের ভেতরে মানুষের পুড়ে যাওয়া হাড় এখনও বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

ঘটনার ২২ দিন অতিবাহিত হলেও লঞ্চটির ভেতর থেকে পোড়া মানুষের তীব্র গন্ধ বের হচ্ছে। লঞ্চটির জায়গায় জায়গায় কালো বর্ণের পেস্টের মতো তীব্র গন্ধযুক্ত আবর্জনার স্তূপ ঘিরে মাছিসহ বিভিন্ন পোকা আবাস গড়েছে। যাত্রীদের জন্য যে বয়া ছিল সেই বয়াগুলো লঞ্চের তাকেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, শুধু কঙ্কালটা শোভা পাচ্ছে। আবার অনেক জিনিস অক্ষত আছে।

যেমন নিচতলায় মির্জাগঞ্জ মরহুম ইয়ার উদ্দিন খলিফা (রহ:) এর মাজারের দানবাক্স, যাত্রীদের ব্যাগের মধ্যে থাকা পবিত্র কুরআন, একটি চায়ের দোকান। যদিও দোকানটির চারপাশ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কয়লার মধ্যে দেখা গেল একটি দুধের ফিডার অক্ষত, কিছু ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখা গেল যেগুলোর চারপাশ আগুনে পুড়ে গেলেও ওই প্রেসক্রিপশনের কাগজগুলোর আগুনে কিছুই হয়নি।

লঞ্চের ইঞ্জিনরুম থেকে শুরু করে কেবিন ঘর, ডেক ও রান্নাঘরসহ যা ছিল- কিছুই আগুন থেকে বাঁচতে পারেনি। এখনও জাহাজের বিভিন্ন অংশ তালা দেওয়া আছে অর্থাৎ লঞ্চটি যখন চলছিল এবং আগুনে পুড়ছিল তখনও এসব জায়গায় তালা দেওয়া ছিল। আর সেসব তালা ভেঙে যাত্রীরা বাইরে বের হতে পেরেছিল কি না তা বলা যাচ্ছে না, তবে এসব জায়গার সবকিছু পুড়ে কয়লার স্তুপ হয়ে আছে যার দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।

স্থানীয় কাঠমিস্ত্রি রাজু বলেন, ওইদিন রাতে আমি কমপক্ষে ৩৫ জনকে লঞ্চ থেকে বের করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়েছি। এদের অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর সময় আমার শরীরে তাদের পুড়ে যাওয়া মাংস লেগে যাচ্ছিল।

বিআইডব্লিউটিসির ম্যানেজার (মেরিন) আল আমিন বলেন, পুড়ে যাওয়া লঞ্চটিতে যেসব ফার্নিচার ছিল সেগুলো ফায়ারপ্রুফ ছিল না। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মিহির বিশ্বাসও গত মঙ্গলবার পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি সরেজমিন পরিদর্শন করেন।

তিনি বলেন, পুড়ে যাওয়া লঞ্চটির ইঞ্জিনসহ যাবতীয় কাঠামোতেই গলদ ছিল। যে কারণে গোটা লঞ্চটি আগুনে পুড়েছে। লঞ্চটির অবকাঠামো যদি গুণগতমান বজায় রেখে নির্মাণ করা হতো তাহলে আগুন লাগলেও এতটা ক্ষতি হতো না।

তিনি আরও বলেন, ইঞ্জিন রুম সুরক্ষিত ছিল না বলেই আগুন বাইরে ছড়িয়ে যায়। লঞ্চের ফার্নিচারগুলো ফায়ারপ্রুফ না হওয়ায় আগুনে পুড়ে যায়। এখনও এ লঞ্চ থেকে মানুষ পোড়া গন্ধ বের হচ্ছে, ভেতরে লঞ্চজুড়েই পোড়া আবর্জনা, যা এখন পরিবেশ দূষণ করছে।

নদী নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা ‘নোঙর’র সভাপতি সুমন শামস এ ঘটনার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ঝালকাঠি প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলা যায়। কেননা একটি লঞ্চ চলাচলের জন্য যে ধরনের ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ম-কানুন মেনে চলার কথা, লঞ্চটিতে তার কিছুই ছিল না।

লঞ্চের বিভিন্ন স্থানে আমরা এখনও তালা দেখতে পেয়েছি। আমার মনে হচ্ছে, ওই সময় ওইখানে যারা ছিল, তারা তালা ভেঙে বেরোতে পারেনি এবং সেখানেই আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। এসব জায়গা থেকে আমরা প্রচুর দুর্গন্ধ পাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, এই লঞ্চ ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও তদারকির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অবহেলা ও অনিয়মের কারণে এই ঘটনা ঘটেছে।

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন