ই-পেপার

বৃষ্টির পানিতে ভাসছে তরমুজ ক্ষেত

নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট: March 27, 2023

“আমার বাজানে এবার ক্ষেতে তরমুজ দেছে, তরমুজ ভালো হইলে বেইচা আমাগো লেখাপড়ার পিছনে খরচ করতে পারবো। সামনে আমাগো বড়ই সুখের সময়”।

মাত্র কিছুদিন আগে বরগুনা সদরের মাঝের চর গ্রামের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মারুফা আক্তার এমন আশার কথাই জানিয়েছিলো বিএসএল নিউজকে।

কিন্তু গত কদিনের ভারীবর্ষণ মারুফার পরিবারের সেই আশার নৈরাশ্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ভারী বর্ষণে বরগুনাসহ উপকূলীয় এলাকার তরমুজ ক্ষেতগুলো এখন পানিতে ডুবে আছে। এতে বড় ক্ষতির সংখ্যা করছেন চাষীরা।

কৃষি বিভাগ বলছে, ‘উপকূলীয় মাটি ও আবহাওয়া চাষের উপযোগী হওয়ায় ক্রমশই তরমুজ চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফার আশার উপকূলের কৃষকরা তরমুজ চাষে ঝুঁকেছেন। তরুণ উদ্যোক্তারাও আশার আলো খুঁজে পেয়েছেন তরমুজ চাষে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছর বরগুনা জেলায় প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদিত তরমুজ ৩০০ কোটি টাকায় বেচাকেনা হয়। তাই এবছরও আগেভাগেই আটঘাট বেঁেধ তরমুজ চাষে নেমে পড়েন চাষীরা।

ইতোমধ্যে আগাম তরমুজ চাষে বেশ লাভবানও হয়েছেন অনেকে। অপেক্ষায় ছিলেন তরমুজের পূর্ণ পরিপক্ষতার জন্য। কিন্তু তার আগেই অকালে বাদলা হয়ে কৃষকের কপালে হতাশার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে টানা ভারীবর্ষণ।

আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, গত ৫-৬ দিন উপকূলে গড়ে ২০-৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরমধ্যে শিলা বৃষ্টিও হয়েছে একদিন। শিলা বৃষ্টিতে তরমুজসহ অন্যান্য ফসল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বরগুনা সদরের বুড়িরচর ইউনিয়নের কৃষক মজিবুর রহমান বলেন, ‘এ বছর ২৬ একর জমিতে তরমুজের চাষাবাদ করছি, কিন্তু এই বৃষ্টিতে ক্ষেতে যে হারে পানি আইটকা রইছে, তাতে আসল টাকা নিয়া ক্ষেত দিয়ে ওঠা দায়!’

সদরের বালিয়াতলী ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান বলেন, ‘তিন একর জমিতে তরমুজ দিয়েছিলাম। সরকারি ভাতার টাকা সবই তরমুজ ক্ষেতের পেছনেই শেষ করছি। এরকম বৃষ্টি হলে চোখে আন্ধার দেখা ছাড়া উপায় থাকবে না!’

শিলাবৃষ্টির কারণে ইতিমধ্যেই একরের পর একর জমির তরমুজ নষ্ট হয়েছে। চাষিরা বলছে, তাদের অনেক তরমুজেই শিলার দাগ লেগে আছে এবং সেখান থেকে পচন ধরছে।

অন্যদিকে জমিতে পানি আটকে থাকায় অনেকের তরমুজের চারাই ভেসে রয়েছে। ফলে তরমুজ গাছের গোড়া পঁচে গাছসহ ফলটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

বরগুনা সদরের তরমুজ চাষী আবু হানিফ বলেন, ‘এনজিও থেকে চড়া সুদে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়া ৩ হেক্টর জমিতে তরমুজ দিছি। কিন্তু যে বৃষ্টি হইছে, সাথে এই ঋণ শোধ করমু ক্যামনে হেই চিন্তায় এহন হুশ জ্ঞান নাই।’

শুধু বরগুনা সদরই নয় আমতলী, তালতলীসহ জেলার সকল উপজেলার চাষীদের একই দশা। এখন সকল তরমুজ চাষী রাতদিন ব্যস্ত মাঠে সেচের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন নিয়ে। অনেকের জমিতে পানি এমনভাবে আটকে আছে যেগুলো নিষ্কাশন হতে হতে তরমুজ চারা পচে যাবে। অনেকে আবার বৃষ্টিন পানি নিষ্কাশন শেষে জমিতে কীটনাশক ও পচনরোধক ঔষধ প্রয়োগে ব্যস্ত।

আমতলী উপজেলা তরমুজ চাষী মো. ফারুক বিএসএল নিউজকে বলেন, ‘এই বৃষ্টি আর ১০-১৫ দিন পরে হলেও তার আগে কয়েক চালান ঢাকায় পাঠানো যেত। কিন্তু তা হলো না। এখন বৃষ্টি না থামলে আমরা ভোগান্তির শিকার হবো।’

এবারের তরমুজ চাষকে কেন্দ্র করে প্রান্তিক পর্যায়ে গড়ে উঠেছিল সার ও কীটনাশকের দোকান। সেসব সার ও কীটনাশকের দোকান থেকে এখন শুধু পচনরোধক ঔষধ বিক্রির হিড়িক।

বরগুনা সদরের মাওয়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী গোলাম কিবরিয়া জানান, ‘বৃষ্টির কয়েকদিন ধরে তরমুজ চাষীরা শুধু সিরাজিন, জি-মেটালিক্স ওষুধ ক্রয় করছেন। এর প্রয়োগে তরমুজের পচনরোধ হয়’।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম বিএসএল নিউজকে বলেন, ‘জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে তরমুজের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ইতোমধ্যেই আমাদের কৃষি অফিসের লোকেরা কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা ভারী বর্ষায় তরমুজ পচনরোধে কৃষকদের করণীয় বিষয় এবং ক্ষেতে কি কি ওষুধ দেওয়া যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করলে কৃষকরা বড়ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে না বলে আশাবাদী এই কর্মকর্তা।

কিছুদিন আগেই জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, ‘এবছর প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। সেখান থেকে উৎপাদিত তরমুজ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ৫০০ কোটি টাকার বেশি দরে বিক্রি হতে পারে।’

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন