হুমায়ুন কবির রোকন | আপডেট: November 22, 2021
সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের পরও বরিশালে বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা অব্যাহত আছে। তাদের অপকৌশলের কারণে প্রতিনিয়ত ঠকছেন ভোক্তা। তবে এ বিষয়ে তৎপর জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
অধিদফতরের তথ্যমতে, বাজার তদারকি ও ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২০-২০২১ অর্থবছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৩ হাজার ১৮টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার অভিযান, ভোক্তার অভিযোগসহ বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিভাগের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নিয়মিত বাজার মনিটরিং ও অভিযান পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে প্রতিনিয়তই অপরাধ ধরা পড়ার পরিমাণ বাড়ছে।
পণ্য ও সেবার মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, নির্ধারিত মূল্যের বেশি নেয়া, ভেজাল পণ্য বিক্রি ও পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করে ব্যবসায়ীরা এখনো ভোক্তাদের ঠকিয়ে যাচ্ছে। তবে অধিদফতরের বিভিন্ন কার্যক্রমে ভোক্তারা কিছুটা সচেতন হচ্ছেন। তারা তাদের অধিকার ক্ষুন্ন হলে অভিযোগ করছেন। আর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সুফলও পাচ্ছেন।
অধিদফতরের বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বাজার তদারকি ও ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২০-২০২১ অর্থবছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের বিভিন্ন ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ৩ হাজার ১৮টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৩০ লাখ ৪১ হাজার ২০০ টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
এছাড়া ২০০ অভিযোগ নিস্পত্তি করা হয়েছে এবং অভিযোগ নিস্পত্তির মাধ্যমে ৪২ প্রতিষ্ঠানকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে পাশাপাশি অভিযোগকারী জরিমানার ২৫ শতাংশ হিসেবে ৮৯ হাজার ৩৭৫ টাকা দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে জমা হওয়া অভিযোগের মধ্যে পণ্যের মোড়কে লেখা নির্ধারিত দামের তুলনায় বেশি রাখার অভিযোগ এসেছে সবচেয়ে বেশি।
এর মধ্যে মোড়কের গায়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যের খুচরা বিক্রয়মূল্য, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ ইত্যাদি লেখা না থাকা, পণ্য ও সেবামূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করা, নির্ধারিত মূল্যের অধিক দাবি করার অপরাধে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রচার না থাকায় অধিদফতরে অভিযোগের সংখ্যা সেভাবে বাড়ছে না। বাজারে প্রতারিত হলেও অনেকে এখনও জানেন না কিভাবে, কোথায় প্রতিকার পেতে হয়।
তবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ধীরে হলেও মানুষজন অধিদফতর সম্পর্কে জানছেন। ফলে তারা সচেতন হচ্ছেন, অভিযোগ নিয়ে আসছেন। দিনে দিনে এ সংখ্যা বাড়বে বলে তারা আশাবাদী। নগরীতে কয়েকজন ভোক্তার সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের সাথে।
তারা কোথাও প্রতারিত হলে অধিদপ্তরে যান কিনা জানতে চাইলে নগরীর রূপাতলী এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘পেঁয়াজ, লবন, আলু ও ভোজ্য তেলের দাম বিনা কারণে লাগামহীন হয়ে যায়, তখন ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কোনো কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়না। তাদের কাছে একটি ছোট কারণে বিচার নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না’।
সদর রোডের এক ভোক্তা মোহাম্মদ রাসেল সিকদার বলেন, ‘অনেক সময় ছোটখাট কারণে ব্যবসায়ীর প্রতারণার শিকার হলেও বিচার চাইতে যাওয়ায় আগ্রহ হয় না। যদিও বিচারে জিতলে প্রতিষ্ঠানটি টাকাও দেয়’।
ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বরিশাল এর সাধারণ সম্পাদক রনজিৎ দত্ত বলেন, ‘অভিযানের পরিমাণ যত বাড়ছে, অপরাধীও ধরা পড়ছে তত বেশি। তার মানে শাস্তি দেয়ার পরও ব্যবসায়ীদের মধ্যে খুব একটা সচেতনতা বা পরিবর্তন আসেছে বলে মনে হচ্ছে না’।
তিনি বলেন, মানুষ সচেতন হলেই কেবল তার সমস্যার প্রতিকার পাবে। যদি সচেতন না হয়, তাহলে অপরাধ বাড়বেই‘। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সহ-সভাপতি, বরিশাল চকবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ আব্দুর রহিম বলেন, ‘এমন কোনো পেশা নাই, যেখানে দু-চারজন খারাপ ব্যবসায়ী নাই। তাদের জন্য আইন আছে, সাজার ব্যবস্থা আছে। যারা অপরাধ করছে তারা সাজা পাচ্ছে।’ অনেক সময় ভোক্তা অধিকার অভিযান পরিচালনা করলে আমারও তাদের সহযোগিতা করে থাকি।
বরিশাল জেলা খাবার হোটেল রেস্তেরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি বিসুঘোষ বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষু অধিদফতরের অভিযানের কারণে খাবার হোটেল রেস্তেরাঁগুলোতে সুন্দর পরিবেশ ফিরে এসেছে। আগের চেয়ে খাবারের মান ভালো হয়েছে।
তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বিভিন্ন সময় হোটেল মালিকদের নিয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করার কারণেই অনেকটা সচেতন হয়েছেন খাবার হোটেল রেস্তেরাঁ মালিকরা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সুমি রাণী মিত্র বলেন, অসাধু ব্যবসায়ী চক্রকে ধরতে আমরা সক্রিয় আছি। প্রতিদিন অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সপ্তাহে পাঁচ দিন তিনটি করে বাজারে অভিযান চলছে। বিশেষ বিশেষ কিছু অভিযানে স্পেশাল মনিটরিং টিম করা হয়েছে।
আর সাধারণ ভোক্তারাও সচেতন হয়ে কোনো অনিয়ম পেলে আমাদের কাছে অভিযোগ করছেন। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতেও অভিযান পরিচালনা করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তাছাড়া অধিদফতরের পক্ষ থেকে সার্বিক বাজার তদারকি করা হচ্ছে। সেখানেও কোনো অনিয়ম পেলে অসাধু ব্যবসায়ীদের আমরা ছাড় দিচ্ছি না।
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা প্রচারণা চালাচ্ছি। এতে করে জনগণ আরও বেশি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সম্পর্কে জানতে পারবে।
জনগণ সচেতন হলে একদিকে যেমন ভোক্তা হিসেবে নিজের অধিকার সম্পর্কে জানতে পারবে, তেমনিভাবে সেবা প্রদানকারী বা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করার সুযোগও কমে আসবে।
জনগণ আগের তুলনায় আরও বেশি সচেতন হচ্ছে। তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। ফলে কোথাও তারা অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে সে ব্যাপারে সোচ্চার হচ্ছেন। এসংখ্যা যত বাড়বে অন্যায় তত কমবে বলে মনে করেন তিনি।’
প্রসঙ্গত, ভোক্তার অধিকার অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল ২০০৯ সালে। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি ধারাবাহিকভাবেই বাজারে তদারকি অভিযান বৃদ্ধি করে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে গ্রাহকের সংশ্লিষ্টতার পরিমাণ।